(ছবি: ক্যানভা প্রো, প্রতীকী)
বাক্ স্বাধীনতা মানে নিজের মত প্রকাশের অধিকার, যা কোনো ভয় ছাড়াই বলা যায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১৯ নং অনুচ্ছেদে এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত: "প্রত্যেকের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে; এই অধিকারে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া মতামত ধারণ করা এবং যেকোনো মাধ্যমে তথ্য ও ধারণা খোঁজা, গ্রহণ ও প্রচার করা।" বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদেও এই অধিকার সুরক্ষিত।
ইতিহাসে দেখা যায়, এই স্বাধীনতা সবসময় সহজে আসেনি। প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিসকে তার মতামতের জন্য বিষপান করতে হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চের বিরুদ্ধে বললে জীবন্ত পোড়ানো হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখ বন্ধ করার জন্য সেন্সরশিপ চালু ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর যুদ্ধ—সবকিছুতেই বাক্ স্বাধীনতা ছিল মূল অস্ত্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা অপব্যবহার হলে কী হয়? ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সময় মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ দেখিয়েছে যে, স্বাধীনতা ছাড়া সমাজ অন্ধকারে ডুবে যায়। তাই সঠিক ব্যবহার জানা মানে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া।
প্রথমত, সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে। বাক্ স্বাধীনতা অপব্যবহার হলে বিভেদ সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে রামুতে ধর্মীয় উস্কানিমূলক ফেসবুক পোস্টের কারণে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হয়, যা শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এটি দেখায় যে, মিথ্যা তথ্য বা ঘৃণা ছড়ানো সমাজকে বিভক্ত করে। সঠিক ব্যবহার মানে সত্য বলা, যা একতা বজায় রাখে।
দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করে। নির্বাচনে মিথ্যা প্রচারণা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে। ২০১৮ সালের বাংলাদেশ নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমত গঠনে প্রভাব ফেলে। সঠিক ব্যবহার জানলে নাগরিকরা দায়িত্বশীলভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে, যা সরকারকে জবাবদিহি করে। জন স্টুয়ার্ট মিলের 'অন লিবার্টি' বইয়ে বলা হয়েছে, স্বাধীন মতামতই সত্যের জয়ী হয়।
তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত উন্নয়ন ঘটায়। সঠিকভাবে বলতে শেখা মানে যুক্তি দিয়ে কথা বলা। শিক্ষার্থীরা ডিবেটে অংশ নিলে তাদের চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা কোর্সে এটি শেখানো হয়, কারণ এটি সমালোচনামূলক চিন্তা বাড়ায়।
চতুর্থত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করে। সিলিকন ভ্যালিতে স্টার্টআপগুলো স্বাধীন মতামতের কারণে উদ্ভাবন করে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন সফল হয়েছে। কিন্তু অপব্যবহার হলে, যেমন কপিরাইট লঙ্ঘন, সৃজনশীলতা কমে।
আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া বাক্ স্বাধীনতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একদিকে, আর্টিকেল ১৯-এর রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বে ৭০% মানুষ অনলাইনে মত প্রকাশ করে। কিন্তু অপরদিকে, ফেক নিউজ, সাইবার বুলিং এবং ট্রোলিং বেড়েছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮-এর অধীনে অনেক সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছে, যা স্বাধীনতাকে সীমিত করে। কোভিড-১৯ মহামারীতে ভ্যাকসিন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।
সঠিক ব্যবহার না জানলে এই প্ল্যাটফর্মগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যায় ফেসবুকের ভূমিকা ছিল উস্কানিমূলক। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনে সোশ্যাল মিডিয়া সচেতনতা বাড়ালেও, কিছু পোস্ট সহিংসতা বাড়িয়েছে। তাই শিক্ষা প্রয়োজন: ফ্যাক্ট-চেকিং, সোর্স যাচাই এবং সহানুভূতিশীল ভাষা।
বাক্ স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার জানা উচিত কারণ এটি শুধু অধিকার নয়, দায়িত্ব। এটি সমাজকে বিভেদ থেকে রক্ষা করে, গণতন্ত্রকে জীবন্ত রাখে এবং ব্যক্তিকে শক্তিশালী করে। আজকের যুবসমাজ, যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, তাদের এই জ্ঞান দিতে হবে। সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া মিলে ক্যাম্পেইন চালাতে হবে। যদি আমরা এটি উপেক্ষা করি, তাহলে স্বাধীনতা অপব্যবহারে পরিণত হবে অরাজকতায়। আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি—বলব সত্য, বলব দায়িত্ব নিয়ে। তাহলেই বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের স্বাধীন দেশ।
Tags
দিগন্ত আলাপ
