(দীপ্তদেশ ডেস্ক): সময়ের স্রোতে মানুষ যেমন নিজেকে বদলে ফেলে, তেমনি বদলে যায় তার সৃষ্টিকর্ম ও সৃজনধারা। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। কালের পরিক্রমায় তালপাতার পুঁথি থেকে মুদ্রিত বই, আর এখন সেই মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে, যার প্রভাব একইসাথে উজ্জ্বল ও বিতর্কিত। এই প্রভাবের এদিক-ওদিক বিচার করা আজ সময়ের দাবি।
ডিজিটাল বিপ্লব বাংলা সাহিত্যের জন্য এনে দিয়েছে অপার সম্ভাবনা। এর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো সাহিত্যের গণতন্ত্রায়ন। আগে লেখালেখি বা প্রকাশনা ছিল একটি সীমিত পরিসরের ব্যাপার, যা নির্ভর করত প্রকাশকের ইচ্ছা ও বাণিজ্যিক মুনাফার ওপর। কিন্তু আজ একজন লেখক সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ই-বুক প্ল্যাটফর্ম বা নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন। এতে নতুন প্রতিভারা আর প্রকাশকের দ্বারস্থ হতে বাধ্য নন; তারা সরাসরি পাঠকের বিচারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছেন।
দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল মাধ্যম সাহিত্যকে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজয়ী করেছে। বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের বাঙালি পাঠক এখন সহজেই বাংলা বই, কবিতা বা গল্প পড়তে পারেন। অনলাইন লাইব্রেরি, ই-বুক স্টোর এবং বিভিন্ন সাহিত্য অ্যাপ এই প্রবাসী বাঙালিদের সাথে তাদের মূল সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য সংযোগ স্থাপন করেছে।
তৃতীয়ত, পাঠক-লেখকের মধ্যে এক নতুন ধরনের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। লেখক তার লেখা নিয়ে পাঠকের মতামত, সমালোচনা এবং প্রশংসা তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে থাকেন, যা তার লেখনীকে আরও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। এই আন্তঃক্রিয়া সাহিত্যকে একঘেয়েমির হাত থেকে রক্ষা করে চলমান রাখে।
যেমন মুদ্রার একপিঠ আছে, তেমনি আছে অপরপিঠ। ডিজিটাল প্রভাবের মধ্যেও লুকিয়ে আছে কিছু উদ্বেগজনক দিক। সবচেয়ে বড় হলো মানের অবনতি। সহজলভ্যতার কারণে অনেকেই চিন্তাভাবনা ও সম্পাদনার তাগিদ উপেক্ষা করে তাড়াহুড়ো করে লেখা প্রকাশ করছেন। এতে সাহিত্যের গভীরতা ও মৌলিকতা হুমকির মুখে পড়ছে। বানান ও ব্যাকরণগত ভুল, অসমাপ্ত চিন্তা এবং অগভীর বিষয়বস্তু অনলাইন সাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মনোযোগের স্থায়িত্বকাল কম। পাঠকরা দীর্ঘ ও গভীর সাহিত্যকর্মের চেয়ে ছোট, সহজে বোঝা যায় এমন লেখা, ফ্ল্যাশ ফিকশন বা মাইক্রো পোয়েট্রির দিকে ঝুঁকছেন। এতে উপন্যাস বা দীর্ঘ প্রবন্ধের মতো মহৎ সাহিত্যধারার পাঠক কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
তৃতীয়ত, কপিরাইট ও মেধাস্বত্ব রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ডিজিটাল মাধ্যমে একটি লেখা সেকেন্ডের মধ্যে হাজারো জায়গায় কপি করা সম্ভব, যার ফলে লেখকের সৃজনশীল পরিশ্রমের স্বীকৃতি ও আর্থিক অধিকার হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতা লেখকদেরকে সাহিত্যের মান না বাড়িয়ে বরং বিতর্কিত বা সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ডিজিটাল প্রভাবকে আমরা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। এটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমাজের বাস্তবতা। তাই আমাদের উচিত এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পথ খুঁজে বের করা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সমন্বয়।
আমাদের মুদ্রিত বইয়ের গন্ধ ও গভীরতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ডিজিটাল মাধ্যমকে একটি সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। নতুন লেখকদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হতে পারে তাদের প্রথম পদক্ষেপ, কিন্তু তাদের লেখার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনার সহযোগিতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাহিত্য সংগঠনগুলোকে ডিজিটাল সাহিত্যের ইতিবাচক দিকগুলোকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি মানসম্মত সৃজনশীল লেখার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
সবশেষে, বাংলা সাহিত্য একটি নদীর মতো, যা সময়ের সাথে সাথে নিজের গতিপথ বদলায়। ডিজিটাল যুগ সেই নদীর এক নতুন প্রবাহ। আমাদের কাজ হলো এই প্রবাহকে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা নয়, বরং এর ধারাকে এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে সাহিত্যের বহুমাত্রিক সৌন্দর্য ও গভীরতা অক্ষুণ্ন থাকে এবং এই নদী আগামী প্রজন্মের কাছেও সমানভাবে প্রাণবন্ত ও প্রেরণাদায়ক হয়ে উঠতে পারে। সেই প্রচেষ্টাতেই নিহিত বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ।
ছবি: pixaby
Tags
সাহিত্য
