(২০৫০ সালের জন্য আমাদের যে বিজ্ঞান প্রয়োজন’ প্রতিপাদ্যে দিবসটি উদযাপনে ওঠে আসে বিজ্ঞানের নৈতিক ব্যবহার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণের আহ্বান)
বিজ্ঞান তথ্য ডেস্ক, দীপ্তদেশ, ১১ নভেম্বর: শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানের অপরিহার্য ভূমিকাকে তুলে ধরে এবং মানবজাতির কল্যাণে এর প্রয়োগকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে আজ সারাদেশে ও বিশ্বজুড়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস ২০২৩। ইউনেসকো ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কাউন্সিলের (ISC) যৌথ উদ্যোগে পালিত দিবসটির এবছরের প্রতিপাদ্য—‘বিশ্বাস, রূপান্তর ও ভবিষ্যৎ: ২০৫০ সালের জন্য আমাদের যে বিজ্ঞান প্রয়োজন’। এই প্রতিপাদ্য বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে এক অনন্য তাৎপর্য বহন করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মহামারী, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সামাজিক অসমতার মতো জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিজ্ঞানের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য সেই আস্থার ভিত্তিকে শক্তিশালী করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার ডাক দেয়। এটি শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রতি নয়, বরং সেই আবিষ্কারগুলো কীভাবে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া যায় এবং সবার কল্যাণে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেদিকেও গুরুত্বারোপ করে।
দিবসটির প্রথম অংশ ‘বিশ্বাস’ আজকের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ভুল তথ্য, গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের যুগে বিজ্ঞানের প্রতি জনগণের বিশ্বাস স্থাপন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন ভ্যাকসিন নিয়ে যে বিতর্ক ও অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল, তা বিজ্ঞান ও সমাজের মধ্যে যোগাযোগের ফাঁক ফোঁকড়গুলো স্পষ্ট করে দিয়েছিল। এই ফাঁক পূরণ করতে হলে বিজ্ঞানী, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদেরকে অবশ্যই সাধারণ মানুষের ভাষায় জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। বিজ্ঞানকে কেবল গবেষণাগারের চার দেয়ালে আবদ্ধ না রেখে তাকে জনবান্ধব করে তোলার ওপর জোর দিয়েছে এবারের প্রতিপাদ্য। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের সাথে সংলাপের মাধ্যমেই বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস পুনর্গঠন সম্ভব।
প্রতিপাদ্যের দ্বিতীয় অংশ ‘রূপান্তর’ বোঝায় বিজ্ঞানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ ও অর্থনীতির মৌলিক পরিবর্তন সাধন করা। এই রূপান্তর কেবল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প এবং প্রশাসন—সব ক্ষেত্রকেই স্পর্শ করে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই রূপান্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত বন্যা, খরা ও লবণাক্ততার মতো সমস্যা মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের ধান, খরা প্রতিরোধী ফসল এবং আধুনিক সেচ প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি খাতের রূপান্তর সম্ভব। স্বাস্থ্য খাতে টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা এবং স্থানীয় পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা এই রূপান্তরের একটি অন্যতম অঙ্গ।
প্রতিপাদ্যের শেষ অংশ ‘ভবিষ্যৎ’ আমাদের দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা ৯৭০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য, শক্তি, জল ও বাসস্থানের চাহিদা মেটানো একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে। একই সাথে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমাদের একটি নতুন ধরনের বিজ্ঞানের প্রয়োজন, যা হবে আন্তঃবিভাগীয় (Interdisciplinary), অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) এবং টেকসই (Sustainable)।
২০৫০ সালের জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান হবে এমন এক বিজ্ঞান যা কেবল জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, বরং মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য নিবেদিত থাকবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়ন, কার্বন ক্যাপচার ও সঞ্চয় প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব উপকরণের আবিষ্কার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক ব্যবহার এবং জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ—এসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ভবিষ্যৎ বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। এই বিজ্ঞানকে অবশ্যই বৈষম্যমুক্ত হতে হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবধান কমিয়ে আনা এবং বিশ্বব্যাপী
বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস শুধু একটি দিনকে স্মরণ করার জন্য নয়; এটি একটি দিনব্যাপী প্রতিজ্ঞা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবজাতির মুক্তি ও অগ্রগতির পথে বিজ্ঞান হলো সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ‘বিশ্বাস, রূপান্তর ও ভবিষ্যৎ’—এই তিন শব্দ আমাদের সামনে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তুলে ধরেছে। বিজ্ঞানের প্রতি জনগণের বিশ্বাস অর্জন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে সমাজকে রূপান্তরিত করা এবং একটি টেকসই, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নির্মাণ—এই লক্ষ্য অর্জনে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব নয়। আজকের এই দিনে আমাদের সংকল্প নিতে হবে যে, আমরা বিজ্ঞানকে কল্যাণমুখী ও জনগণের সেবায় নিয়োজিত রাখবো এবং ২০৫০ সালের জন্য একটি উন্নত বিশ্ব গড়ার প্রয়াসে আমাদের সর্বোচ্চ অবদান রাখবো। কারণ, বিজ্ঞানই হলো আলো, যা অন্ধকার দূর করে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
Tags
দিগন্ত আলাপ
