ট্রাম্পের ২০-দফা গাজা শান্তি প্রস্তাব: শান্তির আশা না নিয়ন্ত্রণের ফাঁদ?

গাজা সিটি, ১৩ অক্টোবর ২০২৫:
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ২০-দফা শান্তি প্রস্তাব, যা গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ঘোষিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সেপ্টেম্বর ২৯ তারিখে হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবটি উন্মোচিত হয়, যাতে ট্রাম্প বলেন, “এটি সভ্যতার ইতিহাসে একটি মহান দিন হতে পারে।” প্রস্তাবের প্রথম পর্যায়ে ৯ অক্টোবর শর্ম এল-শেখে ইসরায়েল এবং হামাস স্বাক্ষর করে, যাতে ২০ জন জীবিত বন্দী মুক্তি এবং ৪৮ জন মোট বন্দীর বিনিময়ে ২৫০ জীবনাদায়ী শাস্তিপ্রাপ্ত এবং ১,৭০০ গাজা-আটককৃত ফিলিস্তিনিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার অস্থায়ী প্রশাসনকে একটি ‘টেকনোক্র্যাটিক, অরাজনৈতিক প্যালেস্টাইনিয়ান কমিটি’র হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা, যা ‘বোর্ড অফ পিস’ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে চলবে—যার চেয়ারম্যান ট্রাম্প নিজেই, সঙ্গে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো পশ্চিমা নেতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে, যদিও যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও।

প্রস্তাবের মূলে রয়েছে গাজাকে ‘ডি-র্যাডিকালাইজড টেরর-ফ্রি জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে হামাসের সামরিক ও আক্রমণাত্মক অবকাঠামো ধ্বংস হয়। হামাসের সদস্যদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অ্যামনেস্টি দেওয়া হবে অথবা অন্য দেশে নিরাপদ পথ প্রদান করা হবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ধাপে ধাপে গাজা থেকে সরে যাবে, কিন্তু একটি নিরাপত্তা পেরিমিটার বজায় থাকবে যতক্ষণ না গাজা ‘পুরোপুরি নিরাপদ’ হয়। রাফাহ ক্রসিং উভয় দিকে খোলা হবে জানুয়ারি ১৯, ২০২৫-এর চুক্তির মেকানিজম অনুসারে, এবং মানবিক সাহায্য বাড়ানো হবে। কিন্তু প্রকৃত লক্ষ্য হলো প্যালেস্টাইন অথরিটির (পিএ) সংস্কার প্রোগ্রাম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত গাজার পুনর্গঠনের ফান্ডিং এবং ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করা। এতে একটি ‘ট্রাম্প ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান’ তৈরি হবে বিশেষজ্ঞ প্যানেল দ্বারা, কিন্তু ফিলিস্তিনি অংশগ্রহণ ছাড়াই। আন্তর্জাতিক স্টেবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) গাজায় মোতায়েন হবে, যা জর্ডান এবং মিশরের পরামর্শে ফিলিস্তিনি পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থাকবে পশ্চিমা হাতে। যদি হামাস প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সাহায্য শুধুমাত্র ‘টেরর-ফ্রি’ এলাকায় চলবে।

আন্তর্জাতিক সমর্থন এই প্রস্তাবকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজা ক্যালাস ৬ অক্টোবর ঘোষণা করেন, “ইউরোপের একটি মহান ভূমিকা আছে এবং আমরা এতে যোগ দিতে চাই।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটিকে “দীর্ঘমেয়াদী শান্তি এবং উন্নয়নের একটি বাস্তবসম্মত পথ” বলে স্বাগত জানান, যখন ইতালির জর্জিয়া মেলোনি এটিকে “একটি টার্নিং পয়েন্ট” বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও সমর্থন দিয়েছেন। প্যালেস্টাইন অথরিটি ট্রাম্পের “আন্তরিক প্রচেষ্টা”কে স্বীকার করেছে, এবং একটি যৌথ বিবৃতিতে কাতার, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব এবং মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেছেন, “আমরা ট্রাম্পের নেতৃত্ব এবং শান্তির পথ খুঁজে বের করার ক্ষমতায় তার আস্থা প্রকাশ করছি।” ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মারও সম্মেলনের সমর্থনে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এই সমর্থনের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ—পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার, এবং আরব দেশগুলোর জন্য ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন। একটি ইন্টারফেইথ ডায়ালগ প্রক্রিয়া চালু হলেও, যা সহনশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর ভিত্তি করে, তা ফিলিস্তিনি ন্যারেটিভকে দমন করার সরঞ্জাম হয়ে উঠতে পারে।

তবে বিরোধিতা এবং সংশয়ও কম নয়। হামাস ৩ অক্টোবর ঘোষণা করে যে তারা বন্দী মুক্তি এবং গাজার প্রশাসন টেকনোক্র্যাটদের হাতে তুলে দেবে, কিন্তু নিরস্ত্রীকরণ বা প্রভাব ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছে। হামাসের একজন কর্মকর্তা হোসাম বদরান বলেছেন, “সদস্যদের গাজা থেকে বিতাড়নের ধারণা অবাস্তব এবং অর্থহীন।” প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) এটিকে “অঞ্চলকে উস্কানিমূলক সূত্র” বলে অভিহিত করেছে। গাজার সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সমর্থন থাকলেও, অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন যে এটি ২০২০-এর ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা, যা ফিলিস্তিনকে দুর্বল করে ইসরায়েলকে শক্তিশালী করেছিল। ট্রাম্পের ছেলে-জামাই জ্যারেড কুশনার এবং স্পেশাল এনভয় স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে আলোচনা সৌদি-ফ্রেঞ্চ প্রস্তাবের সাথে মিলিয়ে পিএ-এর সংস্কারকে ব্যবহার করেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনি যুবকরা বলছেন, “এটি আমাদের কণ্ঠকে চিরতরে মুছে ফেলতে পারে।” ট্রাম্প নিজে ৪ অক্টোবর সিএনএন-এ বলেছেন, “যদি হামাস প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।”

আজ ১৩ অক্টোবর শর্ম এল-শেখে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যাতে ট্রাম্প এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি চেয়ার করবেন, সঙ্গে যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন এবং ফ্রান্সের নেতারা। এতে হামাসের অস্ত্র হস্তান্তর, ইসরায়েলের পূর্ণ প্রত্যাহার এবং গাজা-ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ফিলিস্তিনের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয়কে বিপন্ন করে তুলেছে—একদিকে শান্তির আশা, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণের ভয়। ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব কতটা স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে পারবে, তা নির্ভর করবে তাদের প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক চাপের উপর। এই প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত হবে, তা ভবিষ্যতের পর্যবেক্ষণের বিষয়।

মন্তব্য

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال