হামাসের নিরস্ত্রীকরণ: শান্তির পথ না রাজনৈতিক ফাঁদ

গাজা সিটি, ১৩ অক্টোবর ২০২৫:
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০-দফা গাজা শান্তি প্রস্তাবের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে হামাসের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ—যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের মূল পরিচয়কেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। সেপ্টেম্বর ২৯ তারিখে হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প এই প্রস্তাব উন্মোচন করেন, যাতে তিনি বলেন, “হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে এবং গাজায় কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা থাকবে না, অন্যথায় ‘নরকের মতো’ পরিণতি হবে।” প্রস্তাবের দ্বিতীয় পর্যায়ে হামাসকে সমস্ত অস্ত্র হস্তান্তর করতে হবে, যার বিনিময়ে তাদের সদস্যদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অ্যামনেস্টি দেওয়া হবে অথবা অন্য দেশে নিরাপদ পথ প্রদান করা হবে। কিন্তু হামাসের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ায় এই শর্তটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত রেখে দেওয়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নিরস্ত্রীকরণ শুধু সামরিক নয়, বরং ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আঘাত, যা দীর্ঘমেয়াদে গাজার স্থিতিশীলতাকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

প্রস্তাবের মূলে রয়েছে গাজাকে ‘টেরর-ফ্রি জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে হামাসের সামরিক অবকাঠামো—রকেট লঞ্চার, ড্রোন, মর্টার এবং আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল—সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, হামাসের সদস্যরা যদি ‘ইসরায়েলের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তাদের অ্যামনেস্টি দেওয়া হবে; অন্যথায়, তারা অন্য দেশে চলে যেতে পারবে। এই প্রক্রিয়া ‘বোর্ড অফ পিস’ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে চলবে, যার চেয়ারম্যান ট্রাম্প নিজে এবং সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিত্ব। নেতানিয়াহু এটিকে ‘হামাসকে শেষ করে দেওয়ার সহজ পথ’ বলে অভিহিত করেছেন, যোগ করে যে ইসরায়েল গাজায় একটি ‘নিরাপত্তা পেরিমিটার’ বজায় রাখবে যতক্ষণ না এলাকাটি ‘পুরোপুরি নিরাপদ’ হয়। কিন্তু এই বাধ্যবাধকতা ফিলিস্তিনি দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ‘ভার্সাই চুক্তি’-এর মতো, যা দুর্বল পক্ষকে আরও দুর্বল করে তুলবে। টেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের হামাস বিশেষজ্ঞ মাইকেল মিলস্টেইন বলেছেন, “হামাসের জন্য অস্ত্র ত্যাগ করা তাদের পরিচয়ের মূল নীতি—এটি একটি অসম্ভব চাহিদা, বিশেষ করে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের অভাবে।”

হামাসের প্রতিক্রিয়া এই চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলেছে। ৩ অক্টোবর ঘোষণায় হামাস বলেছে যে তারা বন্দী মুক্তি এবং গাজার প্রশাসন টেকনোক্র্যাটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সম্মত, কিন্তু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেনি। হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজ্জাল বলেছেন, “নিরস্ত্রীকরণ শুধুমাত্র স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পর সম্ভব—দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া বা ভিয়েতনামের ইতিহাস এটি প্রমাণ করে।” গাজায় হামাসের সামরিক নেতা ইজ্জ আদ-দিন আল-হাদ্দাদও এই পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বলে এটি ‘হামাসকে শেষ করার ষড়যন্ত্র’। ফলে, ৯ অক্টোবর শর্ম এল-শেখে চুক্তির প্রথম পর্যায়ে (২০ জন জীবিত বন্দী এবং ৪৮ জন মৃত বন্দীর বিনিময়ে ২৫০ জীবনাদায়ী শাস্তিপ্রাপ্ত এবং ১,৭০০ ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি) নিরস্ত্রীকরণকে স্থগিত রাখা হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে এটি বাধ্যতামূলক। হামাসের প্রত্যাখ্যান ট্রাম্পের ‘তিন-চার দিনের’ আলটিমেটামকে চ্যালেঞ্জ করে, যাতে তিনি বলেছেন, “প্রত্যাখ্যান করলে ‘অভূতপূর্ব নরক’ নামবে।”

আন্তর্জাতিক সমর্থন সত্ত্বেও, নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে বিভক্ততা স্পষ্ট। সৌদি আরব, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর এবং কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, বলে “হামাসকে নিরস্ত্র এবং গাজা থেকে অপসারণ করতে হবে।” ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজা ক্যালাস বলেছেন, “ইউরোপের বড় ভূমিকা আছে এবং আমরা যোগ দিতে চাই।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটিকে “দীর্ঘমেয়াদী শান্তির বাস্তবসম্মত পথ” বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তুরস্ক এবং কাতারের মধ্যস্থতায় হামাস চাপের মুখে পড়লেও, তারা নিরস্ত্রীকরণকে ‘ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐক্যের অংশ’ হিসেবে দেখছে। বিশ্লেষক জন মিয়ার্শাইমারের মতে, এই চাহিদা হামাসের সামরিক প্রতিরোধ, রাজনৈতিক বৈধতা এবং জাতীয় দাবিকে ক্ষুণ্ণ করবে, যা দুর্বল পক্ষকে আরও দুর্বল করে তুলবে।

এই নিরস্ত্রীকরণের সম্ভাব্য প্রভাব ফিলিস্তিনি সমাজে গভীর। গাজার যুবকরা এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সমর্থন থাকলেও, অনেকে বলছেন যে এটি হামাসের কণ্ঠস্বরকে চিরতরে দমন করবে। প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদের মতো অন্যান্য গোষ্ঠীও এটিকে ‘অঞ্চলকে উস্কানিমূলক সূত্র’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। যদি হামাস আংশিক নিরস্ত্রীকরণে (যেমন হালকা অস্ত্র রাখা) সম্মত হয়, তাহলে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে যাবে। আজ শর্ম এল-শেখে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ট্রাম্প এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি চেয়ার করবেন, যাতে নিরস্ত্রীকরণের চূড়ান্ত আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এটি না হলে শান্তি অসম্ভব, কিন্তু হলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা একটি দূরের স্বপ্নে পরিণত হবে। এই প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে, তা ভবিষ্যতের পর্যবেক্ষণের বিষয়।

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের 

মন্তব্য

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال