মহাবিশ্বের রহস্যময় কোণে সম্প্রতি ধরা পড়েছে এক আশ্চর্য দৃশ্য—যেখানে কোনো নক্ষত্রের চারপাশে নয়, বরং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় নিজের জন্মযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এক ভ্রাম্যমাণ গ্রহ। নাম তার Cha 1107-7626, সংক্ষেপে Cha 1107। পৃথিবী থেকে প্রায় ৬২০ আলোকবর্ষ দূরে ‘Chamaeleon I’ নামের তারকা-জন্মভূমিতে অবস্থান এই নবজাত গ্রহের। আকারে এটি বৃহস্পতির প্রায় ৬ থেকে ১০ গুণ, অর্থাৎ এটি কোনো নক্ষত্র নয়, আবার সাধারণ গ্রহও নয়—একটি “রোগ প্ল্যানেট”, যাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন মুক্ত-ভাসমান গ্রহ বা সাব-ব্রাউন ডোয়ার্ফ।
Cha 1107-7626 এর বয়স মাত্র ১ থেকে ৫ মিলিয়ন বছর, অর্থাৎ এটি এখনো এক তরুণ মহাজাগতিক শিশু। তবু এই ক্ষুদ্র বস্তুটি এখন বিজ্ঞানের চোখে বিশাল আলোড়নের কারণ হয়ে উঠেছে, কারণ এটি নিজেই নিজের চারপাশের ধূলি ও গ্যাস টেনে গিলে বাড়ছে—যা আগে শুধু নক্ষত্র বা ব্রাউন ডোয়ার্ফদের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল। ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির (ESO) বিশাল টেলিস্কোপ এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের (JWST) মাধ্যমে দেখা গেছে, সম্প্রতি Cha 1107-7626 প্রবলভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটি একটি “অ্যাক্রিশন বার্স্ট”—একপ্রকার বৃদ্ধি-অভিযান, যেখানে গ্রহটি নিজের চারপাশের গ্যাস-ধূলি টেনে ভেতরে নিচ্ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬ বিলিয়ন টন পদার্থ এতে শোষিত হচ্ছে, যা এক মুহূর্তে কয়েক হাজার গ্রহের জন্মশক্তির সমান। এ ধরনের আকস্মিক বৃদ্ধি বা “বার্স্ট” আগে শুধু তরুণ নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল, কিন্তু এত কম ভরের কোনো গ্রহে এমন ঘটনা এই প্রথম।
অবজারভেশনে দেখা গেছে—এর H-আলফা স্পেকট্রাম লাইন দ্বি-শৃঙ্গ আকৃতি নিয়েছে, যা সাধারণত ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মাধ্যমে পদার্থ টানার ইঙ্গিত দেয়। এ থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, এই একাকী গ্রহটিরও হয়তো চৌম্বকীয় আভ্যন্তরীণ কাঠামো রয়েছে—যা নক্ষত্রের মতোই নিজে থেকে পদার্থ টেনে নিতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, Cha 1107-এর চারপাশে এক ধূলি ও গ্যাসের চাকতি (ডিস্ক) ঘুরছে, যার ভেতরে আছে জলীয় বাষ্প, মিথেন, ও ইথিলিনের মতো অণু—অর্থাৎ এক সম্ভাব্য “গ্রহজন্মের ল্যাবরেটরি”।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরণের গ্রহ প্রমাণ করে যে গ্রহ তৈরি হওয়া নক্ষত্র ছাড়াও সম্ভব, অর্থাৎ মহাবিশ্বে ভেসে বেড়ানো আরও অনেক একাকী গ্রহও হয়তো নিজের জন্মকথা লিখে চলেছে অন্ধকারের মধ্যে। Cha 1107-7626 এখন শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, গ্রহতত্ত্ব ও মহাবিশ্বের জন্মবিজ্ঞানের ধারা বদলে দিচ্ছে—কারণ এটি আমাদের শেখাচ্ছে, একাকীত্বেও সৃষ্টির আগুন জ্বলতে পারে।
চামেলিয়ন I অঞ্চলে আরও এমন বস্তু লুকিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, Cha 1107 একটি শুধু একটি আবিষ্কার নয়, বরং এটি হতে পারে এক নতুন শ্রেণির জন্মকাহিনি—যেখানে নক্ষত্র নয়, গ্রহরাই নিজেদের আলো জ্বালায়। তারমানে গ্রহেরও আলো সৃষ্টির ইতিহাস তৈরি হতে পারে।
ছবি: ESA
Tags
বিজ্ঞান আলাপ
